সকাল বেলা কানের কাছে বিজাতীয় চিৎকার শুনতে কার ভাল লাগে? কলটা করেছে জার্মান বন্ধু ম্যাক্স। বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে ল্যাঙ্গোয়েজ সেটিংটা চেক করলাম। ঠিকঠাক বাংলায় সেট করা। গত বিশ বছর ধরে এই ল্যাংগোয়েজ প্রোগ্রামটা প্রায় নিখুঁতভাবে কাজ করে চলছে। তার আগের একশ বছরে এই আইডিয়া নিয়ে ব্যাপক নিরীক্ষামূলক প্রোগ্রাম বাজারে ছিল। এখন প্রোগ্রামটির পাইনেট টেন ভার্সন চলছে। শুরুর দিকে কিছু ঝামেলা হলেও দশ বছর হল এর কোন বাগের কথা শোনা যায়নি। পৃথিবী জুড়ে সবাই যার যার মাতৃভাষায় কথা বললেও এই কনভার্টারটি প্রাপকের মাতৃভাষায় সেটা বিশুদ্ধ অনুবাদ করে শোনায়। এমনকি এর ভয়েস সিনথেসাইজারটি প্রেরকের গলা নিখুঁত কপি করে। শুধু তাই না, দু'জন মুখোমুখি কথা বললেও, ল্যাঙ্গোয়েজ কনভার্ট করার জন্য এর মাইক্রোফোন সিস্টেমটি অটো অ্যাক্টিভেট হয়ে যায়। ম্যাক্স জানেমান টাইপের বন্ধু। ভাষা বুঝতে না পারলেও ওর টোনটা ধরতে অসুবিধা হয় না। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক জরুরী কোন বিষয়। বলতে না বলতেই আবার ফোন করল ম্যাক্স। একটা ক্ষীণ দুরাশায় ফোনটা ধরলাম আবার। কোন উন্নতি নাই। দুএকটা কথার পরেই ম্যাক্সের গলা শুনে অনুমান করলাম- মা বাপ তুলে গালাগালি করছে। দাঁতে দাঁত কাটলাম, সুযোগ নিচ্ছে শালা। হয়ত বুঝতেও পারে এরকম আশায় ভর করে বললাম, 'শোন আমার ডিভাইসে কোন একটা সমস্যা হয়েছে। তোর কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। প্লিজ একটা মেসেজ করে দে। এই ফাঁকে আমি দেখছি কোন সমাধান করা যায় কিনা?'
কলটা কেটে হ্যারিকে ডাকলাম। হ্যারি আমার গৃহস্থালি রোবট। সমস্যাটা বুঝিয়ে বলতে ও ডিভাইসটা নিয়ে দেখতে থাকল। মেসেজ টোন দেখে, গম্ভীর মুখে আমার দিকে এগিয়ে ধরল। ম্যাক্স ইংরেজিতে লিখেছে, 'তুমি শালা নটা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ আর ওদিকে তোমার মনিকা ম্যাম আমার ঘুম হারাম করে তুলছে। ডিভাইসে কিসের সমস্যা যে, কোন কথা বুঝতে পারছ না? বাপের জন্মে এমন কথা শুনিনি। তুমি আসলেই একটা অপদার্থ।"
মনিকা মানে মনিকা ইউজেন। বাঙালী মা, জার্মান বাবার শঙ্কর- অনিন্দ্য এক রূপসী। ফ্রি ল্যান্সার সাংবাদিক। তার মুখ দেখলে যে কারো ভেতরে ঝিম ঝিম একটা একটা আবেশ চলে আসবে। যেমনটা হয়েছিল আমার আর ম্যাক্সের একসঙ্গে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের একটা বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনারে আমি আর ম্যাক্স যে যার দেশের প্রতিনিধি দলে ছিলাম। মনিকাও এসেছিল কাভার করতে। আকাশচুম্বী গুড উইল। তার যে কোন স্টোরি কেনার জন্য টাইমস, হ্যারল্ডের মত বড় বড় পত্রিকা বিগ অফার নিয়ে বসে থাকে। যে কোন প্রফেশনাল সাংবাদিকের চাইতে মনিকার স্টোরিগুলো আলাদা হবে। সিক্সথ তো খুব কমন ব্যাপার। তার সেভেনথ, এইটথ অথবা নাইনথ সেন্সও আছে বোধ হয়। খবরের আড়ালে কত রকম খবর থাকতে পারে, আর গন্ধ শুঁকে শুঁকে তা কিভাবে বের করে আনতে হয় সে ব্যাপারে মনিকা ইউজেন এক দুর্লভ প্রতিভা। আর এমনই রূপ আর ব্যক্তিত্বের জাদু তার- যে মুখোমুখি হলে আপনা আপনি সব তথ্য জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। যে কোন আন্তর্জাতিক মানের প্রোগ্রামে মনিকার উপস্থিতি অপরিহার্য। বিজ্ঞান বিষয়ক প্রোগ্রামে মনিকা খবরের বাইরেও ভিন্ন কিছুর অনুসন্ধান করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মত অখ্যাত একজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে পড়বে সেটা সুদূর কল্পনাতেও আসেনি।
বাংলাদেশ রোবট গবেষণা প্রকল্পে আমার বিষয় রোবটে বায়োচিপ। বায়োচিপ পুরনো বিষয়। প্রাণী দেহাবশেষ থেকে চিপ তৈরি করে রোবটের সিস্টেমে ইন্সটল করলে রোবটের ইন্টেলিজেন্স অনেক বেড়ে যায়। এটাই হল বায়োচিপ। এই মুহূর্তে মূলত কিছু বাগ নিয়ে গবেষণা চলছে, সেটা অনেকখানিই এগিয়েছে। ফোর্থ জেনারেশনের বায়োচিপযুক্ত রোবটগুলোর অনেক আচরণই বিজ্ঞান বিশ্বে একটা বিস্ময়। এই চিপগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহে ভোগে। পরীক্ষামূলক ভাবে যে কটা রোবটে ইন্সটল করা হয়েছে তারা সবাই- ধারনার বাইরে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ করে গেছে। বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনার পর বায়োচিপ গবেষণা ঝিমিয়ে পড়ে। রবোটিক্সের ছাত্র হওয়ায় সব খবরই আমার জানা ছিল। তবু রিসার্চের সাবজেক্ট হিসেবে বায়োচিপ বেছে নেয়ায় অনেক শিক্ষকই বাধা দিয়েছিলেন। আমার যুক্তি ছিল- আমি অ্যাডাপ্টেড বেবি। এক ধনী নিঃসন্তান দম্পতি মধ্যবয়সে অনাথাশ্রম থেকে আমাকে সংগ্রহ করেছিলেন। তারা আমাকে খুবই ভালবাসতেন। কোন ইচ্ছেতেই কখনো বাধ সাধেননি। মেধাবী হওয়ায়- সেরা ইন্সটিটিউশন গুলোতে পড়িয়েছেন। একটা দুঃখজনক দুর্ঘটনায় দু'জন একসঙ্গে পৃথিবী ছাড়লেও ব্যাংকে আমার জন্য প্রচুর টাকা রেখে গেছেন। তারপরও তাদের মৃত্যু মানসিকভাবে আমার জন্য ছিল বিরাট আঘাত। সারাজীবন পড়াশোনায় মনোযোগী থাকায় তেমন কাছের কোন বন্ধু কখনোই ছিলনা। তারাই ছিলেন আমার একমাত্র আপনজন। বিশাল পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। বেঁচে থাকাটা কিছুদিন খুব ভারী একটা বিষয় বলে মনে হওয়ায় একাডেমিক ইন্টারেস্টেই সম্পূর্ণ মনোযোগ ঢেলে দেই। এরকম ঝুঁকিপূর্ণ গবেষণা আমাকেই মানায়। শিক্ষকরা বরাবরই আমার মেধাকে উৎসাহিত করতেন। ভালও বাসতেন। কোনভাবে নিরস্ত করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মেনে নেন।
হ্যারি আমার হাত থেকে মোবাইল সেটটি নিয়ে দ্রুত হাতে- সেটাকে খুলে ফেলল। রোবটের হাতের কাজ দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করা খুব শক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা চিপ হাতে নিয়ে বলল, 'মেইন ট্রান্সলেটর চিপসটা ঝামেলা করছে। কোম্পানিকে বলে নতুন চিপস আনাতে হবে।' এটা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার। আজকের যুগে ট্রাকিওন কোম্পানির যে কোন চিপস নষ্ট হওয়া প্রায় অসম্ভব। সম্ভাব্য সব রকমের নিখুঁত জিনিস তৈরি করে ওরা। তবু মেনে নিতে হল। বললাম, 'এক্ষুণি ব্যবস্থা কর। ফোন ছাড়া আমি অচল।' হ্যারি ওর কমিউনিকেশন ডিভাইস ব্যবহার করে রবোটিক ভাষায় দ্রুত কিছু তথ্য বিনিময় করে আমার দিকে তাকাল। ওরা বলল, 'নতুন প্রযুক্তি আইনের কারণে অন্তত একদিন সময় লাগবে।'
'তাহলে নতুন একটা সেট কিনে ফেল'।
'কেনা সমস্যা না। কিন্তু আপনি জানেন- নতুন সেটের লাইসেন্স পেতেও সেই একদিন সময়।' আজকাল সব কিছুতেই লাইসেন্স লাগে। এই কমিউনিকেশন ডিভাইসগুলোতে এত কিছু ইন্সটল করা থাকে যে সরকার কিছুতেই ভেরিফিকেশন ছাড়া ব্যবহার করতে দেয় না। পরিচিত কোম্পানির পরিচিত ডিভাইস হলেও না। আমি হতাশায় নখ চিবুতে শুরু করলাম। 'তাহলে কি করা যায়?'
হ্যারি আমাকে আস্বস্ত করে বলল, 'অসুবিধা নাই এই সময়টা আপনার কমিউনিকেশন মিডিয়া করে নিচ্ছি আমাকে। যে কোন যোগাযোগ আমার মাধ্যমে হলে টেনশন ফ্রি থাকতে পারেন।' অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অস্বস্তির সংগে মেনে নিলাম ব্যাপারটা। এমনিতে সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু রোবট যন্ত্র হলেও- তার আচার আচরণ মানুষের কাছাকাছি। প্রাইভেসী ভেঙে যাওয়ার মত একটা অনুভূতি কাজ করে ভেতরে। তাও ভাল যে বাসায় কিছু বায়োচিপ এনে রেখেছিলাম- হ্যারির সিস্টেমে ইন্সটল করার জন্য। ভাগ্যিস করা হয়নি। এ ধরণের বিপদজনক কাজ কেন যেন আমাকে খুব টানে। তাহলে আমার প্রাইভেসী ভেঙে কি যে করে ফেলত আল্লাহ মালুম। বায়োচিপ সেট করা রোবটের আচরণ কখনো আগাম অনুমান করা যায় না। ন্যাচারালি তুমুল ভদ্র। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে পারে। তবে ঠিক কোন কোন কারণে হয় সেটাই একটা রহস্য। আমার আপাত গবেষণা- এই নিয়েই। বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে কিছু প্রিভেন্টিভ নিয়েই কাজ করছিলাম।
পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা আমার জন্য সবচাইতে ঘটনাবহুল সময় হয়ে গেল। ম্যাক্সের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে মনিকা কয়েকবার ফোন করল। এই মেয়েটাকে এড়ানো খুব কঠিন। তার শরীরে বোধ হয় একটা ইনবিল্ট লাই ডিটেক্টর ইন্সটল করা আছে। নিউইয়র্কে বহু কষ্টে তার হাত থেকে ছাড়া পেলেও, এবার এড়ানো যাবে কিনা সন্দেহ আছে। আমি তাই কিছুতেই মেয়েটার মুখোমুখি হতে চাইছিলাম না।' যোগাযোগের সময় হ্যারিকে সেভাবেই ইনস্ট্রাকশনস দিয়ে রেখেছিলাম। কিছুটা স্বস্তিও পাচ্ছিলাম অবশ্য যোগাযোগ হ্যারির মাধ্যমে হচ্ছে বলে। সরাসরি মনিকাকে না বলা পৃথিবীর জটিলতম একটা কাজ। যন্ত্রের অবশ্য এইরকম মানবিক ঝামেলা নাই। হ্যারির মাধ্যমে তাই মনিকাকে কঠোরভাবে জানানো হল, এই রিসার্চের ব্যাপারটা একটা পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত মিডিয়ার সাথে কোনরকম আলাপ করা যাবে না।
কিন্তু সন্ধ্যেবেলা যখন হ্যারি লাজুক মুখে এসে জানাল, মনিকা ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে; মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কঠিন মুখে হ্যারিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমাকে না বলা হয়েছিল ওকে আসতে নিষেধ করতে। তুমি বলনি?'
হ্যারি মাথা নিচু করে বলল, 'হলোগ্রাফিক ভিউতে মেয়েটাকে খুবই সুন্দরী মনে হচ্ছিল। তাছাড়া তার কণ্ঠস্বরও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আর মেয়েটার কথার ভঙ্গীতে এমন একটা সূক্ষ্ম জোর কাজ করে, তাকে এড়ানোর চাইতে আপনাকে মিথ্যা বলা অনেক সহজ।'
আমি অবাক হয়ে হ্যারির দিকে তাকালাম। একদম মানুষের মত কথা বলছে। আমি ওকে আরও একটা কঠিন কথা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎ করেই মনিকা আমার লিভিং রুমে হাজির হয়ে গেল। তারপর হাসিমুখে বলল, 'হাই মি. পাভেল। আপনাকে চমকে দেবার লোভটা কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।'
সেই মাখন কোমল গোলাপি ত্বক, সেই অলৌকিক উজ্জ্বলতা। সেই শ্রাবস্তীর কারুকার্য। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে অচেনা ব্যক্তিত্বের ঝলক- যা এসি বিদ্যুতের মত বারবার টানে আবার দূরে সরায়। যার কোন ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। যিনি বানিয়েছেন- একমাত্র তিনিই বলতে পারেন কি কি অলৌকিক উপাচারে মাঝে মাঝে কাউকে তিনি সাজিয়ে দেন। যার সামনে গেলেই দুর্বল মনে হতে থাকে নিজেকে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। চোখের মধ্যে খেলা করতে থাকে, হতাশা, বিস্ময়, ভীতি আর আনন্দ। আনন্দ! হ্যাঁ আনন্দ। সমস্ত পেশাদারী কঠোরতা ছাপিয়ে এ তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই- ঐ চোখের এমন অলৌকিক যাদু, যা এড়ানো যায় না, যায় না। কিছুতে না। কিছুতেই না।
মেয়েটি কি সব কিছু পড়ে ফেলছে? নগ্ন হয়ে পড়েছে, উদোম হয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরটা? মানুষের চোখের ভাষা মাঝে মাঝে সব ভাষাকে হারিয়ে দেয়। যা কিছু চোখ বলে- পৃথিবীর কোন ভাষারই তা প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। সেই সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কত কবি কতভাবেই না বলেন। তবু অতৃপ্তি, বড় অতৃপ্তি জুড়ে থাকে সব কিছুর মধ্যে।
হঠাৎ আমার মধ্যে একটা উপলব্ধি কাজ করে। আচ্ছা আমার কমিউনিকেশন ডিভাইসে তো সমস্যা। তাহলে ওর কথা আমি বুঝতে পারছি কি করে?
মেয়েটা কি থট রিডার? প্রশ্নটা মনে আসতে না আসতেই বলল, 'আমি কিন্তু বাংলায় কথা বলছি। একেবারে শুদ্ধ অ্যাকসেন্টে। আপনার কমিউনিকেশন ডিভাইসের কোন ভূমিকা নেই এখানে।' আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারো হেসে বলল, 'ভুলে যাচ্ছেন কেন? বাংলা আমার মায়ের ভাষা।' তাইতো, ভাবলাম আমি। তার দেশ যেখানেই হোক- বাংলা তো তার মায়ের ভাষাই বটে। এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, 'আমি জানি, আপনি ভয় পাচ্ছেন, আপনার রিসার্চের সাবজেক্ট নিয়ে কথা বলতে এসেছি। আপনার রিসার্চের বিষয়ে আপনাকে ভাঙা কঠিন হবে জেনে- আমি অন্যভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছি। চাইলে আমার পেপারস দেখতে পারেন।' মেয়েটা তার হাতের নোটবুক দেখাল।
'কিন্তু কিভাবে?' আমার মুখ থেকে অজান্তেই বের হয়ে গেল। মনিকা ইউজেনের কথা অবিশ্বাস করা যায় না। ফালতু কথা বলার রেকর্ড নাই তার। হেসে ফেলে বলল, 'প্রফেশনাল সিক্রেট, আপনার মতই। বলা যাবে না। তবে ভয় পাবেন না প্লিজ। সাংবাদিকতার সব এথিকস মেনে চলি বলেই, আমি মনিকা ইউজেন।'
একটু অবাক হয়েই বললাম, 'তাহলে আমার কাছে কেন?'
'ব্যাপার তো কিছু একটা আছেই। সেই নিউইয়র্ক থেকেই সেটা নিয়ে কথা বলার জন্য আপনার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো ভয় পেয়ে পালিয়েই এলেন। অগত্যা মিস্টার ম্যাক্সকে পাকড়াও করতে হল আপনার নাম্বারের জন্য।'
জার্মান ম্যাক্সের সাথে আমার পরিচয় বছর দুই আগে অসলোর একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে। এই ল্যাঙ্গোয়েজ কনভার্টার- মানুষের ভৌগলিক ব্যবধান এতটাই দূর করে দিয়েছে যে, মুহূর্তে একটা ভাল বন্ধুকে চিনে নিতে একটুও ভুল হয়নি আমার। সেই থেকে ম্যাক্স আমার একমাত্র বন্ধু- যার সাথে সব রকম মনের কথা শেয়ার করা যায়।
'আপনি কিন্তু এখনো বলেননি, রিসার্চ নিয়ে ইন্টারেস্ট না থাকলে আপনি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেন?'
'কারণটা ব্যক্তিগত।'
'ব্যক্তিগত?'
'আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে বায়োচিপ নিয়ে রিসার্চের প্রথমদিকে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছিল?'
'হ্যাঁ, অবশ্যই। এজন্যই আমার শিক্ষক এবং শুভানুধ্যায়ীরা চাননি, আমি রিসার্চে এই সাবজেক্টটা বেছে নেই।'
'তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বাঙ্গালী বিজ্ঞানী আসিফ হাসানের পরিণতির কথা শুনেছেন?'
'হ্যাঁ। মর্মান্তিক একটা দুর্ঘটনা ছিল সেটা। সপরিবারে পুড়ে মরেছিলেন তারা।'
'তার পরিবারে কতজন সদস্য ছিলেন জানেন?'
'দুজনই। নিঃসন্তান ছিলেন তারা।'
'তথ্যটা ভুল।'
'এটাই তো সবাই জানে?'
'হুম। যেদিন তারা মারা যান সেদিনই তার স্ত্রী একটি শিশুর জন্ম দেন। ঘটনাটা বাইরের কেউ জানতোনা। ঘটনার দিন, বিজ্ঞানীর রিসার্চের সাবজেক্ট, বায়োচিপ সেট করা একটা রোবট- হঠাৎ করেই ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আসিফ দম্পতি মারা যান। তাদের পুড়ে যাওয়া দেহ উদ্ধার করা হয় পরে।'
'শিশুটি?'
'না। শিশুটির মৃতদেহ সেখানে ছিল না।'
'তাহলে শিশুর কথা আপনি জানলেন কিভাবে? আপনার এই গল্পের সোর্স কি?'
'আমি জেনেছি, শিশুটি ও তার মায়ের দায়িত্বে থাকা নার্সের কাছ থেকে। ঘটনার কিছু অংশ এবং ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠা রোবটটিকে দেখে সে গোপনে শিশুটিকে নিয়ে পালিয়ে আসে।'
'কেউ জানেনা এরকম একটা ঘটনা যে ঘটনার আড়ালে আছে- সে সন্দেহই বা আপনার হল কিভাবে? কিভাবে আপনি জানলেন সেখানে একটি শিশু এবং একজন নার্স ছিল?'
'কারণ ঘটনাটা আমি জেনেছি, 'তেরেসা ইন্টারন্যাশনাল অনাথাশ্রম- ঢাকা শাখা থেকে।' স্বভাবতই আমার চোখমুখের রঙ বদলে যেতে থাকল। কিছুক্ষণ আমার প্রতিক্রিয়া যাচাই করে মনিকা বলল, 'হ্যাঁ। শিশুটির নাম পাভেল হাসান। রবোটিকসের অত্যন্ত মেধাবী এক বিজ্ঞানী।' একটু থেমে আবার যোগ করল, 'তার বাবার মতই।'
আমি কি বলব, কি প্রতিক্রিয়া দেখাব? এতদিন ধরে নিজের পরিচয় নিয়ে কতরকম কুটিল সন্দেহের মুখোমুখি হতে হতে, বড় হয়ে ওঠা। কখনো তেমন ভাল কোন বন্ধু না গড়ে ওঠার পেছনে এটাই তো ছিল আসল কারণ। যন্ত্রণার আক্রোশ মিটিয়েছি জ্ঞানের জগতে মন প্রাণ সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে। আমার কি কাঁদা উচিৎ? মা বলতেন, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। আর এমন একটা মেয়ের সামনে কাঁদলে- মান সম্মান কিছু কি অবশিষ্ট থাকবে? কিন্তু হঠাৎ করে এত কুয়াশা পড়ল কেন? কেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে চারপাশ? মাথায় হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ তুললাম।
'ইটস অলরাইট পাভেল। মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। আমি আজ এখানে কোন খবরের সন্ধানে আসিনি, বুঝতেই পারছ। আমার মনে হয়েছিল, এ খবরটা তোমাকে নিজ মুখে শোনানোর মত আনন্দ পৃথিবীর খুব কম কাজেই পাব আমি। আজ আমাকে উঠতে হবে।'
ঘোরের মধ্যে বললাম, 'কিছুক্ষণ থাক, প্লিজ। আই নিড ইউ, সাম মোর টাইম।'
'বুঝতে পারছি, তোমার হ্যারিকে ডাক। কিছু খাওয়াতে বল।'
লজ্জা পেয়ে বললাম, 'শিওর। কিন্তু গাধাটা কি করছে এখনো? আমাকে বলতে হবে কেন?' বলে জোরে ডাকলাম, 'হ্যারি।'
হ্যারি দরজার আড়ালেই ছিল। খুব শীতল গলায় বলল, 'খাবার আনছি। বাট ম্যামের তো এখান থেকে যাওয়া হবে না।' মনিকা খুব মজা পেয়ে বলল, 'কেন তোমার স্যারের কাছে রেখে দিতে চাও নাকি? গুড চ্যাপ। কিন্তু তোমার স্যার কিন্তু মুখ ফুটে কথাটা বলতে সাহস পাচ্ছে না?'
'না ম্যাম। ইউ আর সো বিউটিফুল। আপনাকে আমার জন্য রেখে দিতে চাই।'
হ্যারির কথা শুনে আমার মাথার মধ্যে চক্কর দিয়ে উঠল। বায়োচিপে এ ধরণের একটা সমস্যা হতে পারে বলে আমি আঁচ করেছিলাম। কিন্তু ওর সিস্টেমে তো বায়োচিপ ইন্সটল করা হয়নি। মনিকা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'বায়োচিপ সেট করেছ নাকি? হ্যারির আচরণ উল্টা-পাল্টা লাগছে।'
'না।' উত্তরটা দিল হ্যারি। 'স্যার ইন্সটল করেননি। আমি নিজেই ইন্সটল করেছি।'
আমার মাথায় পুরো ইউনিভার্সটাই ভেঙে পড়ল যেন। কণ্ঠস্বর প্রায় হাহাকারের মত শোনাল। 'কোত্থেকে ইন্সটল করেছো হ্যারি?'
'আপনার ল্যাব থেকে।'
'ল্যাব থেকে! কোনটা?'
'একটাই তো পেয়েছি। আপনার টেবিলে সিল করা বক্সে। যেটা নিয়ে আপনি কাজ করছিলেন?'
বিসি-০৫৭৮৯ নাম্বার সিল করা।'
'ওহ।' আমার কণ্ঠ থেকে অটোমেটিক বেরিয়ে এলো শব্দটা।
'ম্যাম, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমি বাঁধব।' মনিকাকে সাংঘাতিক অসুস্থ দেখাল। আমার দিকে তাকিয়ে এমন একটা চোখের ভঙ্গী করল, যে সেই অসহায় মুখটা মুহূর্তে আমার হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে গেল। চোখের দৃষ্টিতে ওকে আস্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মনিকা আস্বস্ত হল বলে মনে হল না।
হ্যারি একটা সিনথেটিকের দড়ি এনে, মনিকাকে কষে বাঁধল। পুরো সময় আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে অভয় দিতে চাইলাম। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে মেয়েটা কুঁকড়েই থাকল। তারপর হ্যারি আমার দিকে লেজার গান তাক করে বলল, 'গুডবাই স্যার। ভেরী সরি। আমি জানি আপনি ওকে ভালবাসেন। আমি প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই না।'
আমার এখন আসলে কিছু করার নেই। নিজের কাজের ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। তবু বললাম, 'কিন্তু হ্যারি। এভাবে তো তুমি নিজেও বেঁচে থাকতে পারবে না। সরকার তোমাকে ধ্বংস করে দেবে।'
'প্রেমের জন্য মরে গিয়েও সুখ স্যার। মুভিতে গানে এসব কথা কতবার শুনেছি।' হ্যারির কণ্ঠ খুব আবেগী মনে হল। 'এনিওয়ে, গুডবাই স্যার।' ওর হাতের আঙুল লেজার গান পেঁচিয়ে ধরল।
'না'। তীক্ষ্ন কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল মনিকা। 'ডোন্ট শুট হিম। ইউ উইল নেভার গেট মি।'
হ্যারির আঙ্গুল ট্রিগারে চেপে বসতে গিয়েও পারছে না। তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করছি আমি। আমার গবেষণা প্রাথমিকভাবে সফল হতে চলছে। একটা উল্লাস ভর করছে আমার মধ্যে।
হ্যারি ধীরে ধীরে হাঁটু ভাজ করে বসে পড়ল। বিড়বিড় করে বলছে, 'আমি পারছি না কেন? কি হচ্ছে আমার?'
'তুমি পারবে না হ্যারি। মানুষকে আন্ডার এস্টিমেট করা ঠিক না তোমাদের। মনে রেখ তারাই তোমাদেরকে বানিয়েছে। নতুন এই চিপটা নিয়ে কাজ করছিলাম আমি। তোমার সিস্টেমে পরীক্ষামূলক ইন্সটল করার জন্যই ছিল এটা। কোন কোন কারণে তোমরা ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে পারো তার কিছু অনুমান ভিত্তিক ডেটা নিয়ে নতুন একটা ডিজাইন করতে চাচ্ছিলাম। সেটা যেহেতু নিশ্চিতভাবে জানিনা। তাই ছোট্ট একটা ভাইরাস সেট করে দিয়েছিলাম যাতে মানুষকে খুন করার ইচ্ছে জাগলেই সেটা অ্যাকটিভেট হয়ে তোমাকে অচল করে দেয়। তোমার খুন করার ইচ্ছের সাথে সেটাকে মিলিয়ে তৈরি করাটা একটু জটিলই ছিল। আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল। এই ভাইরাসটা এখন তোমাকে মেরে ফেলবে। আমি দুঃখিত। তবে তুমি তোমার এই ছোট্ট জীবনটা নিয়ে গর্ব করতে পার। অনেক বড় একটা অর্জনের পথে তুমি ভলান্টিয়ার হয়ে রইলে। গুড বাই হ্যারি।'
একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলাম আমি। হ্যারি ততক্ষণে মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। বিড়বিড় করছে, 'সরি স্যার, সরি ম্যাম। আমাকে মাফ করে দেবেন। আমার কি হয়ে গিয়েছিল আমি নিজেই জানি না। ফরগিভ মি স্যার, ফরগিভ মি...'
আমার চোখ আবারো ব্যথায় সজল হয়ে ওঠে। অনেকগুলো দিন আমার খুব বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ছিল হ্যারি। ওর মৃত্যুর জন্যও তো প্রকারান্তরে আমিই দায়ী। আমি এগিয়ে গিয়ে মনিকার বাধন খুলে দিতেই, সে পাগলের মত আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে। তারপর আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ায়। হ্যারি করুণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমার চোখ আবারো সজল হয়। মনিকা বুঝতে পেরে হাতের চেটো দিয়ে হাল্কা করে মুছে দিল। আমরা দুজন এগিয়ে যাই হ্যারির দিকে।
হ্যারি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 'ম্যাম, স্যার বড় একা। আই নো হিম ভেরী ক্লোজলি। খুব ভাল মানুষ তিনি। প্লিজ ডোন্ট লেট হিম স্টে অ্যালোন। প্লিজ টেক প্রপার কেয়ার অব হিম।' আমরা দুজন হ্যারির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকি। হ্যারি পূর্ণ চোখ মেলে তাকায় আমাদের দিকে। আমার কি কোন ভুল হচ্ছে। মনে হল ওর রোবট চোখে পুরো মানুষের দৃষ্টি দেখলাম। প্রায় শোনা যায় না, এমন ক্ষীণ কণ্ঠে হ্যারি বলল, 'বিদায় স্যার। আমাকে ভুলে যাবেন না প্লিজ।' তারপরই ওর মাথাটা ঢলে পড়ল। আর আমি নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ি ওর ওপর। পিছনে মনিকা আমার চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে।
......................................
বাংলাদেশে মনিকা এবার কোন খবর সংগ্রহ করতে আসেনি। কিন্তু হঠাৎ করে নিজেই একটা বিশাল খবর হয়ে গেল। এক সপ্তাহ পর সমস্ত বড় বড় মিডিয়া পৃথিবীকে একটা ব্রেকিং নিউজ দিল। বিয়ে করতে যাচ্ছেন প্রতিভাবান জার্মান ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক মনিকা ইউজেন। তার হবু বর, সাবেক বিশ্বখ্যাত প্রতিভাবান বাংলাদেশী বিজ্ঞানী আসিফ হাসানের সুযোগ্য সন্তান পাভেল হাসান। আমরা তাদের....। ম্যাক্স অবশ্য আগেই ওকে এই বলে অভিনন্দন জানিয়েছে, 'শালা আমার উড বি সেকেন্ড ওয়াইফটাকে আমাকে না জানিয়েই পটিয়ে ফেললি।'